নরসিংদী হানাদার মুক্ত দিবস: ১২ ডিসেম্বরের গৌরবময় ইতিহাস
১২ ডিসেম্বর ১৯৭১, একটি দিন যা নরসিংদীর মানুষের জন্য চিরস্মরণীয়। এই দিনে নরসিংদী পাক হানাদার বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত হয়। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ নরসিংদীর মুক্তি বাংলাদেশের বিজয়ের দ্বারকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।
নরসিংদীর মুক্তিযুদ্ধ: এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়
মার্চ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পর থেকে পাক হানাদার বাহিনী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। নরসিংদী, ঢাকা থেকে সন্নিকটে অবস্থিত একটি কৌশলগত অঞ্চল, হানাদার বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে ওঠে। তারা এখানে তাদের শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে এবং স্থানীয় সহযোগীদের (রাজাকার ও আল-বদর) সহায়তায় নরসিংদীর মানুষদের ওপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। নরসিংদীর মানুষ কিন্তু এই অত্যাচারের মুখে নীরব ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে একত্র হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। হাজারো ছাত্র ও যুবক প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।
মুক্তির
পথযাত্রা
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী নরসিংদী শহরে বোমা বর্ষণ শুরু করে। এই বর্বর হামলায় বহু নিরীহ মানুষ শহীদ হন। নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। বিশেষ করে নেহাব গ্রামে নেভাল সিরাজের নেতৃত্বে গঠিত প্রতিরোধ দুর্গ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি বড় শক্তি। পাকিস্তানি বাহিনী নরসিংদী টেলিফোন ভবনে তাদের প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে এবং রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে হত্যা, লুটতরাজ এবং ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড চালায়। এর বিপরীতে, মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ এবং চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে তাদের দুর্বল করতে থাকে।
১২ ডিসেম্বর: নরসিংদী মুক্ত দিবস
১২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পরাজিত হয়। নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে যেমন বাঘবাড়ি, পাঁচদোনা, পুটিয়া, এবং বড়িবাড়িতে সংঘটিত যুদ্ধ মুক্তির পথ সুগম করে। বিশেষ করে, বেলাব উপজেলার বড়িবাড়ির নীলকুঠি যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য ছিল অভূতপূর্ব। মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি এবং সাহসিকতার সামনে পাকিস্তানি বাহিনী টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে নরসিংদী পাক হানাদার মুক্ত হয়।
নরসিংদীর শহীদদের আত্মত্যাগ
মুক্তিযুদ্ধের সময় নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে জেলার ১১৬ জন বীর সন্তান শহীদ হন। তাদের মধ্যে নরসিংদী সদর উপজেলার ২৭ জন, মনোহরদীর ১২ জন, পলাশের ১১ জন, শিবপুরের ১৩ জন, রায়পুরার ৩৭ জন এবং বেলাব উপজেলার ১৬ জন শহীদ হন। এ ছাড়া, অসংখ্য মা-বোনের নীরব আত্মত্যাগের বিনিময়ে হানাদার মুক্ত হয় নরসিংদী।
বধ্যভূমি ও স্মৃতিচিহ্ন
পাকিস্তানি সেনারা নরসিংদীর ১৫টি বধ্যভূমিতে নির্বিচারে হত্যা চালায়। তাদের সহচর রাজাকাররা সাধারণ মানুষকে ধরে এনে হত্যা করত। আজও নরসিংদীর কিছু বধ্যভূমি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। চিহ্নিত বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে পাঁচদোনা, বড়িবাড়ি এবং মেথিকান্দা উল্লেখযোগ্য। পাঁচদোনায় নির্মিত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা করছে। কিন্তু বড়িবাড়ির নীলকুঠির স্মৃতিসৌধ অযত্ন-অবহেলায় রয়েছে। এই স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণ করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।
নরসিংদীর বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা
নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার (অব.) এএনএম নুরুজ্জামান (বীর উত্তম), লে. কর্নেল আব্দুর রউফ (বীর বিক্রম), এবং নেভাল সিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ (বীরপ্রতীক)। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শহীদ হয়েছেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সরোজ কুমার অধিকারী এবং ড. সাদত আলী।
মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা ও করণীয়
নরসিংদী হানাদার মুক্ত দিবস আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে। নরসিংদীর মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি এবং স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে। শহীদদের নামানুসারে সড়ক ও স্থানের নামকরণ করার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
উপসংহার
নরসিংদী
হানাদার মুক্ত দিবস কেবল একটি
তারিখ নয়, এটি একটি
গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের প্রতীক। ১২ ডিসেম্বর নরসিংদীবাসীর
কাছে চিরস্মরণীয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের ফলে অর্জিত স্বাধীনতা
আমাদের গর্ব। আসুন, এই মহান মুক্তিযুদ্ধের
চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা একটি
সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ
গড়ে তুলি।
এই বাক্যে লিংকযুক্ত শব্দ মাউস রেখে দেখুন।
Post a Comment